Saturday 18 July 2015

।। উৎসর্গ ।।

গত অক্ষয় তৃতীয়ার আগের দিন সোমনাথদার পালার দিন আমাদের খড়দা শ্রীরাধাশ্যামসুন্দর মন্দিরের রাসমঞ্চের সামনে আমাদের এক জ্ঞাতি ও গুরুজন প্রভুপাদ শ্যামল গোস্বামীর সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয় । কথাপ্রসঙ্গে উনি বলেন , ''আমাদের গুরুবংশে তো ঘরে ঘরে মন্ত্র , নিত্যানন্দ বংশের সেই গুরুপরম্পরা হারিয়ে যেতে দিওনা, বৈদ্যনাথদার বয়স হয়েছে , হয়তো আর বেশীদিন নেই , চলে যাবার আগে নিয়ে রাখো । '' 

সেদিন ওঁ-কার মাথায় ধরা ওই খালি রাসমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর অসীম স্নেহের কথাই প্রথমে মনে এসেছিল । যা লিখতে গেলে একটা গ্রন্থ লেখা হয়ে যায় । আর বেশিদিন নেই - একথা যেন বারবার কানে বাজছিল । পরদিন মনস্থির করে মন্ত্র নিয়েছিলাম কানে । ছোটো থেকে যখনই যা দিতে চেয়েছেন না বলে এসেছি । তাই সেদিন যখন গিয়ে বলি আজ তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছি বৃদ্ধ তাত একইসাথে অবাক ও খুশি হয়েছিলেন । জীবনের শেষ সময়ে তাঁর হাজারো শিষ্যের ভীড়ে তাঁর অতিপ্রিয়জনটিকে একজন করে পাবেন , হয়তো ভাবেননি ।

এর ঠিক চার সপ্তাহ পর ,অসুস্থ গুরুকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয় । এই সময়ে সবকিছু নিয়েও মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অকৃতজ্ঞ আত্মীয় দেখেছি , বিরহে আকুল শিষ্য দেখেছি , অর্থের অহংকারের দান ও হাসিমুখে তাঁর তা ফিরিয়ে দেওয়া দেখেছি , নার্স-ডাক্তারের আপ্রাণতা দেখেছি, অসহ্য মৃত্যু-যন্ত্রণাতেও তাঁর ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা তৃপ্তির হাসি - চোখে সবার জন্য সেই ভালোবাসা দেখেছি ।

দেড়মাস বাড়ি ফিরিনি । একইসাথে অন্য আরেকটি নার্সিংহোমে কিডনি-পেশেন্ট মা ভর্তি ছিলেন । দিনে হাসপাতাল , রাতে অষ্টাবক্র গীতা লিখতাম । তাই ছিল দিবাশেষের ক্লান্ত আমির আশ্রয় । 
রথের পর অষ্টমী-নবমীর মাঝে গুরু দেহ রাখেন । তাঁর শেষ ইচ্ছানুসারে আমি তাঁর মূখাগ্নি করি । সারাজীবন নিষ্কাম সেবায় কাটিয়ে হাসিমুখে চলে যাওয়ার একটি মাস আর কিছু না বলা কথা আমায় কলম ধরিয়েছে । আদি শঙ্করের 'ভজ গোবিন্দম্ ভগবদ্পদ' কি , তা দেখিয়েছে ।
শান্তি কোথায় , বন্ধন কি , মুক্তি কেমন , বেদান্ত অজান্তেই আমাদের জীবনের কতখানি জূড়ে আছে , ওঁমকার , ঈশ্বর , বিশ্বাস , গুরুতত্ত্বের অপার স্নেহের দান এই বেদান্তের মূল সুরটি কোথায় হয়তো আমার এই ক্ষুদ্র বইখানি পড়লে কিছুটা ধারনা করা যাবে । 

আমরা গৃহী , সংসারে থেকেও ঈশ্বরে কিভাবে ডুবে থাকা যায় তা ঠাকুর আমাদের শিখিয়ে গ্যাছেন । তিনি যে  বাংলার আধ্যাত্মজগতের কতখানি জুড়ে আছেন , তা উপলব্ধি করেছি যখন 'টাকা মাটি মাটি টাকা' র মতো মানিক্যগুলি লিখতে লিখতে মনের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে প্রচ্ছন্নভাবে শব্দের আধার হয়েছে ।  

স্বামীজির বাড়ি আমার অতিপ্রিয় স্থান । কারণে অকারণে কিছু এক টান বারবার আমাকে টেনে নিয়ে যায় । তাঁর সেই বেদবাণী এ জীবন আমায় উপলব্ধি করিয়েছে । তাই সংসারের প্রতি কাজের মাঝে একথা আমি চুপিচুপি বলি ,

'এই জগতে ধনের সন্ধান করিতে গিয়া তোমাকেই শ্রেষ্ঠ রত্নরূপে পাইয়াছি; হে প্রভো, তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম ।
ভালবাসার পাত্র খুঁজিতে গিয়া একমাত্র তোমাকেই ভালবাসার পাত্র পাইয়াছি। তাই তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।'  



No comments:

Post a Comment