Sunday 19 July 2015

ভূমিকা

বেদান্তের কথা তো আমরা সবাই শুনেছি, জানি । কিন্তু একটা খটকা বোধহয় মনের মধ্যে রয়েই যায় । তিনি নিরাকার জেনেও সাকারে তাঁকে ডাকা যেন আরো সহজ - এই বোধ । মা সন্তানকে ভালোবাসেন, সে ভালোবাসা বোঝা যায় , তার অভিব্যক্তি আছে, তা দৃশ্য । কিন্তু ভগবানের ভালোবাসা আবার কিরকম , তাঁকে তো দেখাও যায়না । কাকে সাজাবো , কাকে যত্ন করবো , কেবা আমার একান্ত আপনজনের মতো আমার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেবে ? 

ঠিক এখানেই শরীরধারী গুরুর প্রয়োজন । আমাদের দেহবোধ অশরীরী অব্যক্তকে হৃদয়ঙ্গম করতে বাধা দেয় । হাজার বেদান্তকথা শুনলেও মনকে একই জায়গায় বেঁধে রাখে । রূপ । নাম রূপের অতীত যিনি তাঁকে নামে ডাকার চেষ্টা - সাকাররূপে ধরার চেষ্টা ।

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে আছে - ঠাকুর বলেছেন -----

" দুই-ই সত্য। শুধু নিরাকার বলা কিরূপ জানো? যেমন রোশনচৌকির একজন পোঁ ধরে থাকে...... তার বাঁশির সাত ফোকর সত্ত্বেও। কিন্তু আর-একজন দেখ কত রাগ-রাগিণী বাজায়! সেরূপ সাকারবাদীরা দেখ ঈশ্বরকে কতভাবে সম্ভোগ করে ! শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর.... নানাভাবে। 
কি জানো, অমৃতকুণ্ডে কোনও রকমে পড়া। তা স্তব করেই হোক অথবা কেউ ধাক্কা মেরেছে আর তুমি কুণ্ডে পড়ে গেছ, একই ফল। দুই জনেই অমর হবে!
ব্রাহ্মদের পক্ষে জল বরফ উপমা ঠিক। সচ্চিদানন্দ যেন অনন্ত জলরাশি। মহাসাগরের জল, ঠান্ডা দেশে স্থানে স্থানে যেমন বরফের আকার ধারণ করে, সেইরূপ ভক্তি হিমে সেই সচ্চিদানন্দ (সগুণ ব্রহ্ম) ভক্তের জন্য সাকার রূপ ধারণ করেন। ঋষিরা সেই অতীন্দ্রিয় চিন্ময় রূপ দর্শন করেছিলেন, আবার তাঁর সঙ্গে কথা কয়েছিলেন। ভক্তের প্রেমের শরীর, ‘ভাগবতীতনু’ দ্বারা সেই চিন্ময় রূপ দর্শন হয়। আবার আছে, ব্রহ্ম অবাঙ্মনসোগোচর। জ্ঞানসূর্যের তাপে সাকার বরফ গলে যায়। ব্রহ্মজ্ঞানের পর, নির্বিকল্পসমাধির পর, আবার সেই অনন্ত, বাক্যমনের অতীত, অরূপ নিরাকার ব্রহ্ম!
ব্রহ্মের স্বরূপ মুখে বলা যায় না, চুপ হয়ে যায়। অনন্তকে কে মুখে বোঝাবে! পাখি যত উপরে উঠে, তার উপর আরও আছে । "

তাই ব্রহ্মকথা শূনলেই আমাকে সাকার উপেক্ষা করতে হবে এমন নয় । শ্রীকৃষ্ণ যেমন ব্রজের রেণু রেণুতে ছড়িয়ে আছেন , তেমনি ব্রহ্ম এ জগতের কণা কণায় রয়েছেন , প্রতি জীবের মধ্যে আছেন - এ উপলব্ধিতেই সাকার-নিরাকারের মেলবন্ধন । 
তাই বেদান্তের সারকথা , তা-ই নিষ্কাম সেবার মূলমন্ত্র ।। 

সাকার যদি তোমায় দেখি তবে যেন সে দৃষ্টিতে প্রতিটি জীবের মধ্যে তোমায় দেখতে সক্ষম হই । নিজের সাথে যেমনি সাবলীল, অনায়াস ,, প্রত্যেককে যেন তেমনি করে আপন করে নিতে পারি - বাঙালীর প্রতিটি হৃদয়ে উচ্চারিত হোক আজ এই প্রার্থনা ।।

সনাতন ধর্মের সর্বপ্রধান ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত আত্মজ্ঞানের 42 টি শ্লোক নিয়ে এই বেদান্ত-বইটির প্রথম বিভাগ ।
ভাগবদ্গীতার প্রতিটি অধ্যায় ,অতগুলি শ্লোক সাধারনের পক্ষে মননে আনা দুরূহ । তাই এই সহজ - বেদান্ত বইটিতে এই 42টি শ্লোক সাজানো হল। ইংরেজি অনুবাদের জন্য শ্রী রমনা মহর্ষির চরণে কৃতজ্ঞতা জানাই।
  
দ্বিতীয় আদিগুরু শঙ্করাচার্যের 'ভজ গোবিন্দম্' ভগবৎ পদাবলী । জগদগুরু কাশী বেনারসের ঘাটে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যাকরণ রপ্ত করতে দেখে ভজ-গোবিন্দম্ গেয়েছিলেন । তার বারোটি মূখ্য শ্লোক নিয়ে এই 'ভগবৎ-পদ ' ।।

উপনিষদ-ই বেদান্তের মূলসূত্র । তাই তৃতীয় ও চতূর্থ ভাগে আছে ছোট্ট দুখানি উপনিষদ । শুক্ল-যজূর্বেদ ও অথর্ববেদ থেকে নেওয়া 'ঈশাভাষ্য' ও 'মাণ্ডূক্য' -  সেইসাথে গৌড়পদের মাণ্ডূক্য কারিকা । 
'ঈশাভাষ্য' - আঠারো শ্লোকের এই উপনিষদ, অদ্বৈতবেদান্তরত্ন শঙ্কর যে ঈশা-অর্থে অদ্বিতীয় আত্মা এবং দ্বৈতবেদান্ত অনুসারে মাধবাচার্য তাঁর ভাষ্যে ঈশা অর্থে শ্রীবিষ্ণু এবং তাঁতে একাত্ম হওয়ার আহ্বান করেছেন ।। 

'মাণ্ডূক্য'  উপনিষদ প্রনব বা ওম্-কারের চরন । চেতনের চার স্তর ও ওম্-এর চার চরণময় এ উপনিষদ বারোটি শ্লোকে বিস্তৃত ।। গৌড়পদের 'কারিকা'য় এই উপনিষদেরই বিশ্লেষণ ।।

পঞ্চম ভাগে আছে অষ্টবক্র গীতা । রাজা জনক ও অষ্টবক্র মুনির মধ্যে আত্মজ্ঞানের উপর যে কথোপকথন হয়েছিল ,  আঠারোটি অধ্যায়ে বিস্তৃত এ এক অনবদ্য গান, যা 'অষ্টবক্র গীতা' নামে বিখ্যাত ।

ষষ্ঠ ও অন্তিম চরণে রয়েছে অদ্বৈত বেদান্তের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি । 'দৃগ্দৃশ্য বিবেক ' যা না পড়লে নির্গূণ ব্রহ্মের কল্পনাও আসেনা । ধ্যান, সমাধি, সবিকল্প ও নির্বিকল্প , দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা। স্বরূপ থেকে অরূপ । এর অনুবাদ সহজ নয় , স্বামী প্রজ্ঞানন্দজী এই অনুবাদটির পাণ্ডুলিপির কয়েকটি জায়গা সঠিক করে দিয়েছেন , স্বামী নির্গূণানন্দজী এই বইএর প্রকাশনায় যথেষ্ট সহায়তা করেছেন, তাঁদের সহৃদয় সাহায্যে আমি কৃতজ্ঞ ।

শ্রী বিবেক দেবরায় এই বইখানি লেখার মূল প্রেরণা । বাংলার মাটি থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে থেকেও বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় । বাংলা মায়ের যে কৃতি সন্তানরা আজ ভারতের গৌরব , তাঁদেরই একজন আমাদের এই বিবেকদাদা । বেদান্তির জীবনই যে বেদান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।। 

কৃতজ্ঞতা বেদান্ত সোসাইটির ভগবানকে,প্রত্যেকের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ বড় সহজ ,বড় আপন । 'মায়ের বাড়ি' ও 'বেদান্ত' যে কত দুঃখীজনের সাহারা হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আনন্দ কতখানি বেশী তাঁর জীবনী এর উদাহরণ ।।     

গুরুজীর কথাই বা কি বলি !! ভারতের একতার বাণী ও বেদান্তের ঐশর্যকে জগতের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেবার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন , তাঁর সেই সংকল্পশক্তি অতুলনীয় । তদোপরি যে যেমন তাকে ঠিক সেইভাবে স্বীকার করা এ কি সহজ কাজ !! স্বামী শ্রদ্ধানন্দজী যেন সেই শক্তিরই প্রতিবিম্ব ।

সবশেষে যাঁর চরণে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজ এখানে এই লেখাটি শেষ করবো তিনি স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী । ঠাকুর মা ও স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই মহাত্মা জীবসেবায় আত্মদান করেছেন, তিনি আমাদের সবার প্রণম্য । বাংলার সাধারন মানুষের জন্য লেখা - একথা শোনামাত্র তিনি তাঁর অমূল্য সময় দিয়ে যে সহযোগীতা করেছেন , তা অনস্বীকার্য ।।

 

No comments:

Post a Comment